এই সুবিশাল পৃথিবীটি প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর পুরোনো। এখানে রয়েছে প্রায় ১০ কোটি প্রজাতির প্রাণী, ৩ লক্ষ ৯০ হাজার উদ্ভিদ, অসংখ্য নদী, পাহাড়, আকাশ, সূর্য ও চাঁদের বিস্ময়। আর এই অসংখ্য সৃষ্টির মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব ‘মানুষ’। মানুষ হতে পারে পুরুষ, নারী কিংবা তৃতীয় লিঙ্গের কেউ। হতে পারেন শিক্ষক, কৃষক, ডাক্তার, শিল্পী, রাজনীতিক বা কর্মচারী। কিন্তু আপনার প্রধান পরিচয় একটাই— আপনি একজন মানুষ।
মানুষের জীবনের শুরু হয় একটি স্পার্ম ও একটি ডিম্বাণুর মিলনে। প্রতি মিলিলিটার বীর্যে থাকে প্রায় ১০ কোটি স্পার্ম, কিন্তু সাধারণত মাত্র একটি স্পার্মই সফল হয়। সেই একটি সফল মিলন থেকেই জন্ম নেয় নতুন প্রাণ। এর মধ্যেই নির্ধারিত হয়ে যায় শিশুর জেনেটিক বৈশিষ্ট্য, অর্থাৎ চোখের রং, উচ্চতা, চুলের ধরন ইত্যাদি। এরপর নিষিক্ত ডিম্বাণুটি গর্ভাশয়ে পৌঁছে দেয়ালে ঝুলে পড়ে। কোষ বিভাজনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ভ্রূণের আকৃতি ধারণ করে। প্রথমে চিবানো মাংসপিণ্ডের মতো, পরে হাড় গঠন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং অবশেষে হৃদস্পন্দনের শুরু হয়। ১২০ দিনের মাথায় সৃষ্টিকর্তা গর্ভের শিশুতে আত্মা (রূহ) দান করেন। তখন শিশুর তাকদির লিখে দেওয়া হয়।
শিশু গর্ভে তিনটি স্তরের নিরাপত্তা পায়। এখানে তাকে দেওয়া হয় প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা, অক্সিজেন ও পুষ্টি। ৯ মাসে যখন সে পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে, তখন অক্সিটোসিন হরমোনের প্রভাবে জন্মের প্রক্রিয়া শুরু হয়। জন্মের পর শিশু যখন প্রথমবার কান্না করে, তখন তার ফুসফুস কাজ করতে শুরু করে। মায়ের দুধ তাকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দেয় এবং তার চোখ, কান ও চর্মের অনুভূতি জাগ্রত হয়। ধীরে ধীরে সে চেনা-অচেনার পার্থক্য করতে শেখে।
মানুষের চোখ, হাত, পা ও দেহের গঠন নিঃসন্দেহে অসাধারণ। তবে শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়— মস্তিষ্কই মানুষকে সকল সৃষ্টির চেয়ে শ্রেষ্ঠ করে তুলেছে। মস্তিষ্কের ওজন প্রায় ১.৩ থেকে ১.৫ কেজি। এখানে ১০ হাজার কোটি নিউরন রয়েছে, যা পুরো মহাবিশ্বের তারকার সংখ্যার চেয়েও বেশি! প্রতি সেকেন্ডে ১০০০ ট্রিলিয়ন নিউরাল কানেকশন তৈরি হয়, যা কোনো সুপারকম্পিউটারও করতে পারে না। মস্তিষ্কের সংকেত (নিউরন সিগন্যাল) ঘণ্টায় ৪৩৪ কিমি বেগে ছুটতে পারে! এটি এত দ্রুত কাজ করে যে মাত্র ১৩ মিলিসেকেন্ডে (০.০১৩ সেকেন্ড) একটি ছবি চিনতে পারা যায়। ১ সেকেন্ডে ৫০টি আলাদা তথ্য নিতে পরে মস্তিষ্ক। মস্তিষ্ক পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মেমোরি ডিভাইস! এখানে ২.৫ পেটাবাইট তথ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব, যা ৩০০ বছরের ভিডিও সংরক্ষণ করার সমান! মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস অংশ স্মৃতি সংরক্ষণ করে এবং নতুন জিনিস শিখতে সাহায্য করে। ঘুমানোর সময়ও মস্তিষ্ক কাজ করে, এ সময় মস্তিষ্ক স্মৃতি সংরক্ষণ করে। মস্তিষ্কের এমিগডালা অংশ ভয়, আনন্দ, দুঃখ ও ভালোবাসার অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে; অক্সিটোসিন হরমোন ভালোবাসা ও বিশ্বাস বাড়ায়; ডোপামিন হরমোন সুখ ও আনন্দ তৈরি করে। মানুষের মস্তিষ্কের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা পৃথিবীর অন্য কোনো প্রাণীর নেই। এর নিউরোপ্লাস্টিসিটি ক্ষমতা রয়েছে, যা ক্ষতিগ্রস্ত হলে নিজেকে সারিয়ে তুলতে পারে!
এই মস্তিষ্ক কেবল শরীর নিয়ন্ত্রণ করে না; এটি কল্পনা করে, আবিষ্কার করে, স্বপ্ন দেখে, ভালোবাসে এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে পারে।
এইভাবেই গড়ে ওঠে মানুষের পরিচয়— শরীর, মন, বুদ্ধি, আবেগ ও আত্মার সম্মিলনে এক জটিল অথচ অপূর্ব সৃষ্টি। কিন্তু সেই পরিচয় সত্যিকার অর্থে স্পষ্ট হয় তখনই, যখন কেউ নিজেকে জানতে চায়। জানতে চায়: আমি কে? আমি কেন বেঁচে আছি? এই জীবনের উদ্দেশ্য কী? এই প্রশ্ন থেকেই শুরু হয় আত্ম-অন্বেষণ। আর সেই উত্তরগুলোকে লিখে রাখাই হলো— নিজের পরিচয় সংরক্ষণের শ্রেষ্ঠ উপায়।